• Home
  • Current News
  • অনাথ ৬ বন্ধুর এসএসসি জয়

অনাথ ৬ বন্ধুর এসএসসি জয়

ছোটকালেই তারা বাবাকে হারিয়েছেন। অভাবের তারনা আর নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। কখনো নিকটতম স্বজনের স্নেহের পরশ পাবার সৌভাগ্যও হয়নি তাদের। নেই প্রতিবেশি, নেই পরিচিত কেউ।

ঠিকানাহীন এমন ৬ বালক এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন পেয়েছেন জিপিএ-৫। সবার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দুঃখিনি মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার। অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে ওঠে আসা এই ছয় বালক একে অপরের বন্ধু। তারা হলেন- শ্রী সাগর টপ্পো, বিপ্লব বাবু, আব্দুল মজিদ, সাজ্জাদুল ইসলাম সিয়াম, আরিফুল ইসলাম জয় এবং সাগর চন্দ্র রায়।

ছোট থেকে তারা বেড়ে ওঠেছেন পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে’। এ বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারা। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের মতো স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরো ১৬০ জন মা-বাবাহীন শিশু।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমূল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।

রোববার বিকেলে এই শিশু নগরীতে গিয়ে দেখা যায়, দুই পাশে দুটি বড় বড় ভবন। মাঝে একটি বিশালাকার খেলার মাঠ। শিশুদের পদচারণায় মুখর মাঠটি। সেখানে কথা হয় সদ্য এসএসসি পাশ করা এই ছয়জনের সঙ্গে।

জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন সাগর টপ্পো। রংপুরের মিঠাপুকুরে তাদের বাড়ি ছিলো। ২০১২ সালে তার দিনমুজুর বাবা সামছুল টপ্পো মারা যান। এরপর থেকেই ছোট্ট সাগর মায়ের সঙ্গে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, শুরু হয় ভাসমান জীবনযাপন। থাকতে হতো খেয়ে না খেয়ে। পড়ালেখাতো ছিলো কল্পনাতীত। সেখান থেকে এক সমাজকর্মী উদ্ধার করে ২০১৪ সালে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই দেয় সাগরকে। এরপর থেকে শুরু হয় তার নতুন স্বপ্ন দেখা। প্রাথমিকেও ভালো ফলাফল ছিলো তার। প্রকৌশলী হতে চান সাগর, দেশের জন্য কিছু করতে চান তিনি।

জিপিএ-৪.৫৪ পাওয়া বিপ্লব বাবু জানান, বাবা-মায়ের সঙ্গে রংপুরে থাকতেন তিনি। বাবা এরশাদ আলীর মৃত্যুর পর খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো তাদের। ২০১৩ সালে এক দুঃসম্পর্কের স্বজনের মাধ্যমে এখানে আসেন তিনি। বলেন, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাশ করবো- এটা ছিলো স্বপ্নের মতো। পাশ করেছি, এই অনুভূতি বুঝাতে পারবো না। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।

জিপিএ-৪.৫৪ পেয়েছেন আব্দুল মজিদও। তিনি বলেন, আমার জন্মস্থান দিনাজপুরে। ২০০৯ সালে আমার বাবা নিরুদ্দেশ হন। বেঁচে আছেন কি-না জানি না, মা ঢাকায় থাকেন। আমিও ঢাকায় একটি অনাথআলয়ে ছিলাম। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর ঠাঁই হয় এখানে।  ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই এবং এ বছর এসএসসি পাশ করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরো ভালো করতে চাই।

সাজ্জাদুল ইসলামের সিয়ামের রেজাল্ট জিপিএ-৪.৩২। তিনিও বাবা হারিয়েছেন অবুঝ কালে, থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। তিনি বলেন, ‌‘কখনো কারো আদর স্নেহ পাইনি। আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন কি-না তাও জানি না। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক।’

জিপিএ-৩.৮২ পেয়ে উত্তীর্ণ আরিফুল ইসলাম জয় বলেন, ঢাকায় থাকতাম। বাবার মৃত্যুর পর এখানে ঠাঁই হয়, মা ঢাকায় গৃহকর্ত্রীর কাজ করেন। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়। আমাদের বাড়ি কই জানি না, মায়ের কাছে কখনো জানতেও চাইনি।

জিপিএ-৩.৭১ পাওয়া সাগর চন্দ্র রায় কখনই বাবাকে দেখেননি। তার জন্মের পর পরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা শলন্ত রায়। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানেন না। শুধু জানেন তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, মায়ের নাম কুসু রানী। 

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সী ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ৬ জনের মতো প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকেই রয়েছে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া, জানে না নিজের পরিচয়। আবার কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। এমনও আছে কারো বাবা-মা দুজনই নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছে তারা। সময়মতো পড়ালেখা, বাকীসময় খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে পার করে তারা।

শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, শিশুদেরকে এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। সদ্য এসএসসি পাশ করা ৬ জনও এখান থেকেই প্রাথমিক শেষ করেছিলো। শিশুদের যাবতীয় খরচবহনসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে আহছানিয়া মিশন।

শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাঁই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হবার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে শিখে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে। 

তিনি বলেন, আহছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য হলো এই শিশুদের ১৮ বছর পূর্ণ হলে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সদ্য এসএসসি পাশদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে আহছানিয়া মিশন।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দিপক কুমার রায় বলেন, অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ৬ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একজন জিপিএ-৫ সহ সবার ভালো ফলাফল এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে। দিপক কুমার রায় বলেন, এই শিশু নগরী গত এক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় চলছিলো। তবে গত দেড় বছর ধরে আহছানিয়া মিশনের নিজস্ব অর্থায়নে চালাতে হচ্ছে। এতে নানান সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি বা দাতা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত না বাড়ালে হিমশিম খেতে হবে। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে শিশুদের সব স্বপ্ন। এই মহতি কার্যক্রম ধরে রাখতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।